ইনকিলাব
প্রকাশ:২ জুন, ২০২৫
ফাইল ছবি | ইনকিলাব
তিনি এমনই এক সোনার মানুষ ছিলেন, যিনি প্রাণ-প্রকৃতিকে ভালোবাসার এক অনুকরণীয় জীবন যাপন করে গেছেন। বন–প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে উদ্ভিদ ও প্রকৃতির সুখ-দুঃখের গল্প তিনি শুনেছেন, শুনিয়েছেনও। এই দেশে তাঁর মতো দরদমাখা এমন বৃক্ষকথা কে আমাদের শুনিয়েছে? বহুমাত্রিক লেখালেখি, অধ্যাপনা ও সমাজসেবার পাশাপাশি তিনি বৃক্ষরোপণের মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছেন। তাঁর জীবন ও কর্মের এই বিশেষ দিকটি কখনো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়নি।
রমনা পার্কে দ্বিজেন শর্মার রোপণ করা পালাম ফুলছবি: লেখকের কাছ থেকে সংগৃহীত
দ্বিজেন দেশের যে প্রান্তেই গেছেন বা থেকেছেন, সেখানেই গাছ লাগিয়েছেন, বাগান করেছেন। ঢাকা, বরিশাল, টাঙ্গাইল, রাজশাহী সর্বত্র এই সন্তানতুল্য উদ্ভিদগুলো তাঁর স্মৃতিস্মারক হয়ে বেঁচে আছে। ঢাকায় তিনি অনেক গাছ রোপণ করেন। ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, নটর ডেম কলেজ, রমনা পার্ক, বাংলা একাডেমি, মহানগর পাঠাগার, শিশু একাডেমি, চারুকলা প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন গাছগুলো টিকে আছে।
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে অনেক গাছ রোপণ করলেও একটি স্মৃতি বেশ তরতাজা। তিনি প্রায় দুই দশক আগে তাঁর জন্মভিটা মৌলভীবাজার জেলার পাথারিয়া পাহাড় থেকে দুষ্প্রাপ্য দুলিচাঁপার দুটি চারা সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তারই একটি ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই বেশ উৎসাহ–উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে রোপণ করা হয়। অন্যটি রমনা পার্কে। সেদিন এমন একটি দুর্লভ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
রমনা পার্কে দ্বিজেন শর্মার রোপণ করা বাওবাব ফুলছবি: লেখকের কাছ থেকে সংগৃহীত
দ্বিজেন শর্মা জীবনের শেষ দিনগুলো সিদ্ধেশ্বরীতেই কাটিয়েছেন। সেখান থেকে হাঁটা দূরত্বে ছিল রমনা পার্ক। প্রায় প্রতিদিন যাওয়া-আসার সুবাদে পার্কটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। সময়ের ব্যবধান থাকলেও এ সময় সেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গাছ রোপণ করেন। যে গাছগুলো এখন পার্কের অনন্য বৃক্ষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। অরুণোদয় গেট পেরিয়ে খানিকটা এগোলেই পাওয়া যাবে তাঁর লাগানো একমাত্র মাকড়িশালগাছটি। এত দিনে গাছটি ডালপালা ছড়িয়ে বেশ বড়সড় বৃক্ষ হয়ে উঠেছে। মাকড়িশালের আরেক নাম বনাক। বনের বিপন্ন প্রজাতির গাছ। ঢাকায় এ গাছ দুষ্প্রাপ্য। সেখান থেকে আরেকটু এগোলে বাঁ পাশে আছে সেই দুলিচাঁপা। মাকড়িশাল আর দুলিচাঁপা একই দিনে লাগানো হয়েছিল। বাংলাদেশের একমাত্র বুনো ম্যাগনোলিয়া এটি। এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগেও দেখা হলো গাছটির সঙ্গে। বড় বড় পাতার রাজসিক গাছটি আলাদাভাবে চেনা যায়। উচ্চতায় আকাশচুম্বী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করি। পাথারিয়ার প্রাকৃতিক আবাসে দুলিচাঁপার সুবিশাল মাতৃগাছটিও দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
রমনা পার্কে দ্বিজেন শর্মার রোপণ করা বাওবাব গাছছবি: লেখকের কাছ থেকে সংগৃহীত
খানিকটা বাঁ দিকে ঘুরে মাইলামের বীথি ছাড়িয়ে একটু এগোলে কাছাকাছি চারটি গাছ কনকচাঁপা, আগর, কাউয়াতুতি আর লেডিস আমব্রেলা। প্রথমোক্ত তিনটি তাঁর লাগানো গাছ। কাউয়াতুতি নিয়ে ঘটেছিল মজার ঘটনা। পারুল ভেবে চারাটি পাহাড় থেকে নিয়ে এসেছিলেন, পরে সেটা পারুল না হয়ে হলো কাউয়াতুতি। হয়তো ভুল চারার কারসাজি! তবে দুর্লভ কনকচাঁপার চারাটি রোপণ করা হয়েছিল কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। কারণ, গাছটির প্রতি তাঁর আলাদা মমতা ছিল। কনকচাঁপার এই চারা সংগ্রহ করেছিলেন শিশু একাডেমির বাগান থেকে। বাসার টবেই বড় হয়ে ওঠে গাছটি। একদিন ভাবলেন টবে তো আর ওর ঘরসংসার হবে না। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে রমনায় রোপণ করা হলো গাছটি। তারপর নিজের অনুভূতির কথা লিখেছিলেন এভাবে, ‘বাড়ি ফিরি শূন্য হাতে, দেখি ওর জায়গাটা খালি, কিছুক্ষণ আগেও ছিল, এখন নেই। দুপুরের নিয়মিত ঘুম আর আসে না। বিকালের আগেই পার্কে ছুটে যাই। চারাটি দেখি, ভালোই আছে।’ সেই কনকচাঁপাটি কয়েক বছর ধরে পার্কে নিয়মিত ফুল দিচ্ছে।
২০১৬ সালে জন্মদিনে পার্কের মহুয়া চত্বরের পাশে স্ত্রী দেবী শর্মাকে নিয়ে একটি হিমঝুরি গাছের চারা রোপণ করেন দ্বিজেন শর্মাছবি: লেখকের কাছ থেকে সংগৃহীত
কনকচাঁপা থেকে নার্সারির দিকে সোজা হাঁটলে সামনে পড়বে ছোট্ট রেলিং। তার ভেতরেই দেখা যাবে দ্বিজেন শর্মার আরেক আদুরে কন্যা পালাম বা পালানকে। এই চারাও পাহাড় থেকে নিয়ে আসা। গ্রীষ্মে গাঢ়-লাল রঙের অসংখ্য ফুলে ভরে থাকে গাছ। নার্সারির পাশ ঘেঁষে অস্তাচলের দিকে গেলে পাওয়া যাবে বাওবাবগাছটি। মরু অঞ্চলের এই গাছ আমাদের দেশে আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। মনে পড়ে, একদিন তাঁর সঙ্গে এ গাছ দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন গাছটি। তারপর কাণ্ডে হাত রেখে ওপরে তাকিয়ে শুভ্রতায় মোড়ানো কয়েকটি বড় বড় ফুল আবিষ্কার করে পুলকিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে জন্মদিনে পার্কের মহুয়া চত্বরের পাশে স্ত্রী দেবী শর্মাকে নিয়ে একটি হিমঝুরিগাছের চারা রোপণ করেন তিনি। চার বছর ধরে গাছটিতে নিয়মিত ফুল ফুটছে।
দেখেছি, প্রায়ই তিনি পার্কে লাগানো সন্তানতুল্য গাছগুলোর পাশে দাঁড়াতেন, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতেন, ওদের সঙ্গে কথা বলতেন। এভাবেই উদ্ভিদের সঙ্গে মিলেমিশে তিনি কাটিয়ে দেন অনন্য এক জীবন। জন্মদিনে তাঁকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।